আখেরি চাহার সোম্বা: পরিচিতি, ইতিহাস, গুরুত্ব, শিক্ষা ও উদযাপন
আখেরি চাহার সোম্বা কি, আখেরি চাহার সোম্বা কি, আখেরি চাহার সোম্বা মানে কি, আখেরি চাহার সোম্বা অর্থ কি, আখেরি চাহার সোম্বা কি?, আখেরি চাহার সোম্বা কী
আখেরি চাহার শোম্বা হলো বাংলাদেশের ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের পালন করা একটি মর্যাদাপূর্ণ স্মারক দিবস। “আখেরি চাহার সোম্বা” শব্দটি আরবি ও ফারসি ভাষার সমন্বয়; যেখানে আরবি “আখেরি” অর্থ “শেষ” এবং ফারসি “চাহার সোম্বা” অর্থ “বুধবার”। হিজরি সনের সফর মাসের শেষ বুধবারকে আখেরি চাহার শোম্বা বলা হয়। এই দিনে, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) শেষবারের মতো রোগ থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেছিলেন বলে, মুসলমানরা প্রতি বছর এ দিনটিকে শুকরিয়ার দিবস হিসেবে পালন করে থাকেন।
আখেরি চাহার সোম্বা ২০২৪, আখেরি চাহার সোম্বা কত তারিখ
২০২৪ সালে আখেরি চাহার সোম্বা পালিত হবে ৪ সেপ্টেম্বর, বুধবার।
আখেরি চাহার সোম্বা কেন, আখেরি চাহার সোম্বা কেন পালন করা হয়
মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনে আখেরি চাহার শোম্বা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর ইহজগত ত্যাগের আগে, এই দিনটি তিনি কিছুটা সুস্থতা অনুভব করেছিলেন। ফারসিতে “আখেরি চাহার শোম্বা” মানে “শেষ চতুর্থ বুধবার”। এই দিনে নবীজী তাঁর পার্থিব জীবনের শেষ সময়ে কিছুটা আরোগ্য লাভ করেছিলেন। ফলে মুসলমানরা প্রতি বছর এই দিনটিকে ‘শুকরিয়া দিবস’ হিসেবে উদযাপন করেন এবং নফল ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে দিনটি কাটান। উম্মতে মুহাম্মদির আধ্যাত্মিক জীবনে আখেরি চাহার শোম্বার গুরুত্ব ও মহিমা অপরিসীম।
আখেরি চাহার সোম্বা কি সরকারি ছুটি
আখেরি চাহার শোম্বা পালনের জন্য বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসা, দরবার, এবং জিকির-আজকার, মিলাদ মাহফিল, দোয়া ও মোনাজাতের আয়োজন করা হয়। এদিন, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারিভাবে বন্ধ থাকে এবং অফিস-আদালতে এ দিনটি ঐচ্ছিক ছুটির দিন হিসেবে বিবেচিত হয়।
আখেরি চাহার সোম্বা পটভূমি
১১ হিজরির শুরুতে মুহাম্মদ (সা.) গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তাঁর শারীরিক অবস্থার ক্রমাগত অবনতি ঘটে। এতটাই অসুস্থ হয়ে যান যে, নামাজের ইমামতি করতে পারছিলেন না। ২৮ সফর বুধবার, সফর মাসের শেষ বুধবার, তিনি কিছুটা সুস্থ হন।
এই দিন সুস্থতা অনুভব করার পর তিনি গোসল করেন এবং শেষবারের মতো নামাজে ইমামতি করেন। মদিনার বাসিন্দারা এই খবরে আনন্দিত হন এবং দলে দলে এসে তাঁকে একনজর দেখতে আসেন। সবাই তাঁদের সাধ্যমতো দান-সাদকা প্রদান করেন, ধন্যবাদ জানান এবং দোয়া করেন। নবীর সুস্থতায় তাঁরা এতটাই খুশি হন যে, কেউ দাস মুক্তি দেন, কেউ অর্থ বা উট দান করেন। উদাহরণস্বরূপ, আবু বকর সিদ্দিক ৫ হাজার দিরহাম, উমর ৭ হাজার দিরহাম, ওসমান ১০ হাজার দিরহাম, আলি ৩ হাজার দিরহাম, এবং আবদুর রহমান ইবনে আউফ ১০০ উট দান করেছিলেন।
অবশ্য, ২৯ সফর তার স্বাস্থ্য আবার খারাপ হতে শুরু করে এবং কিছুদিন পর, ১২ রবিউল আউয়াল তিনি ইহকাল ত্যাগ করেন।
আখেরি চাহার সোম্বার তাৎপর্য
আল্লাহর প্রিয় হাবিব হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পৃথিবীতে ৬৩ বছর জীবনযাপন করেছেন। এই সময়ে তিনি কখনোই বড় ধরনের রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হননি। অবিশ্বাসীদের নানা অত্যাচার ও নির্যাতনের মধ্যেও তিনি তাওহিদের বার্তা পৌঁছে দিতে অক্লান্তভাবে কাজ করে গেছেন। পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে তিনি পরকালীন জীবনে প্রবেশ করবেন—এটাই আল্লাহর সিদ্ধান্ত ছিল। তবে, তার মৃত্যুর পূর্বে তিনি রোগাক্রান্ত হন। তাঁর অসুস্থতা ক্রমে বাড়তে থাকলে উম্মুল মু’মিনীন এবং সাহাবাগণ গভীর উদ্বেগে পড়েন।
সফর মাসের শেষ বুধবার আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছুটা সুস্থতা অনুভব করেন। তিনি উম্মুল মু’মিনীন আয়িশা সিদ্দিকা রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহাকে ডেকে বলেন, “আয়িশা, আমার কাছে এসো ও আমার কথা শোনো।” আয়িশা সিদ্দিকা দ্রুত উপস্থিত হন এবং জিজ্ঞাসা করেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আমার বাবা-মা আপনার জন্য উৎসর্গিত হোক! আমাকে কি জন্য ডেকেছেন?”
রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “আয়িশা, আমার মাথাব্যথা কমেছে এবং আমি কিছুটা সুস্থ অনুভব করছি। হাসান, হোসাইন ও মা ফাতিমাকে আমার কাছে ডেকে নিয়ে এসো।” আয়িশা রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহা তা করলেন এবং রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাথায় পানি ঢাললেন, তাঁকে সুন্দরভাবে গোসল করালেন। এই খবর মদিনা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল এবং অনেক সাহাবী আনন্দিত হয়ে উঠলেন। কেউ দাস মুক্তি দিলেন, কেউ উট দান করলেন, কেউবা বহু দান-সাদকা করলেন। সাহাবীগণ রাব্বুল আলামীনের কাছে শুকরিয়ার নামাজ ও দোয়া করলেন।
এ দিনটি ছিল সফর মাসের শেষ বুধবার, যা “আখেরি চাহার সোম্বা” নামে পরিচিত। “আখেরি” অর্থ শেষ এবং “চাহার সোম্বা” মানে বুধবার। এটি রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনের শেষ বুধবার ছিল। পরবর্তীতে, বৃহস্পতিবার থেকে তাঁর অসুস্থতা আবার বৃদ্ধি পেতে থাকে। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইতোমধ্যে পরকালীন জীবনযাত্রার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিলেন, যেমন একজন মুসাফির দূরবর্তী সফরের আগে প্রস্তুতি নেয়। তাঁর ইন্তিকালের পূর্বে তাঁর বিদায় যাত্রার প্রস্তুতির লক্ষণ দেখে সাহাবীগণ বুঝতে পারেন যে, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের মাঝে বেশি দিন থাকবেন না। উদাহরণস্বরূপ, রমজানের শেষ দশ দিন তিনি ই’তিকাফ পালন করতেন এবং সেই বছর জিব্রাইল আলাইহিসসালাম তাঁকে পুরো কুরআন দু’বার শোনান। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও জিব্রাইল আলাইহিসসালামকে পুরো কুরআন দু’বার শোনান। বিদায় হজ্বের ভাষণে তিনি বলেছিলেন, “আজকের দিন যেসময় আমি তোমাদের মাঝে একত্রিত হয়েছি, হয়তো এখানেই আমার শেষ সমাবেশ হবে।
আখেরি চাহার সোম্বার ইতিহাস
আখেরি চাহার সোম্বার ইতিহাস নিয়ে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে কিছু বৈচিত্র্য রয়েছে। এই দিনের বিশেষ গুরুত্ব ও পালন নিয়ে কিছু মূল বিষয় নিম্নরূপ:
- ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট: আখেরি চাহার সোম্বা সাধারণত সফর মাসের শেষ বুধবার হিসেবে পালিত হয়। এটি বিশেষভাবে ইসলামের মৌলিক উৎসাহিত দিনের মধ্যে গণ্য না হলেও, কিছু মুসলিম সম্প্রদায় এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসেবে পালন করে।
- নবী মুহাম্মদ (সা.): নবী মুহাম্মদ (সা.) এর সময়কালে বিশেষভাবে এই দিনটির সাথে সম্পর্কিত কোনো বড় ধরনের ঘটনা বা বিশেষ নির্দেশনা উল্লেখ পাওয়া যায় না। তবে, নবীর রোগমুক্তি ও তাঁর সুস্থতা উপলক্ষে কিছু মুসলিম সম্প্রদায় এই দিনটি উদযাপন করে থাকেন।
- উদযাপন ও প্রথা: বিভিন্ন অঞ্চলে আখেরি চাহার সোম্বা উদযাপন করার বিভিন্ন প্রথা রয়েছে। এর মধ্যে নামাজ, দোয়া, দান-সাদকা, ও অন্যান্য ধর্মীয় কাজ অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। এটি সাধারণত স্থানীয় সংস্কৃতি ও ধর্মীয় প্রথার ওপর ভিত্তি করে পালন করা হয়।
- স্থানীয় প্রথা: মুসলিম সমাজে আখেরি চাহার সোম্বার প্রতি বিশেষ মনোযোগ ও উদযাপন বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন হতে পারে। কিছু স্থানে এটি একটি ধর্মীয় উৎসব হিসেবে পালন করা হয়, যেখানে লোকেরা দোয়া, নামাজ এবং দান-সাদকা করে থাকে।
এছাড়া, কিছু মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে আখেরি চাহার সোম্বার ইতিহাস ও গুরুত্ব নিয়ে আরও বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যেতে পারে, যা স্থানীয় ইসলামিক স্কলার বা ধর্মীয় পণ্ডিতদের সাথে আলোচনা করে জানা যেতে পারে।
আখেরি চাহার সোম্বা উদযাপন
সফর মাসের শেষ বুধবার, হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দীর্ঘ অসুস্থতার পর সাময়িক সুস্থতার দিনকে স্মরণ করে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে যে ইবাদত ও উৎসব প্রচলিত, তা হল ‘আখেরি চাহার সোম্বা’। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে মুসলিমরা রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে এই উৎসব-ইবাদত যথাযথ ধর্মীয় ভাবগম্ভীর্যের সাথে পালন করে থাকেন।
পারস্য প্রভাবিত অঞ্চলসহ ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশে বহু যুগ ধরে ‘আখেরি চাহার সোম্বা’ ইসলাম ও মুসলিম সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। এ অঞ্চলের সুফি-সাধকরা এবং দিল্লি সালতানাতের শাসকগণ রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এই দিনটি পালন করতেন।
বিশ্বব্যাপী একযোগে দিনটি যথাযথভাবে পালিত না হওয়ায়, বর্তমান সময়ে অনেকেই ‘আখেরি চাহার সোম্বা’ উদযাপন ও এর তাৎপর্য নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। তাদের বক্তব্য, আখেরি চাহার সোম্বা পালনের বিষয়ে কোনো হাদিসের দলিল নেই এবং সাহাবায়ে কেরাম এই দিনটি খুশির দিন হিসেবে উদযাপন করেছেন বা প্রতি বছর দান-সাদকা করেছেন এমন কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্যও নেই।
এ কারণে অনেকের ধারণা, যেহেতু সাহাবায়ে কেরামদের যুগ ও পরবর্তী সময়ে এই দিনটির কোন বিশেষ গুরুত্ব ছিল না, তাই আখেরি চাহার সোম্বা ঘটা করে পালনের কোনো যৌক্তিকতা নেই।
তবে, পৃথিবীর সব অঞ্চলের মুসলমানরা যথাযথ ধর্মীয় ভাবগম্ভীর্যের সাথে দিনটি পালন না করলেও, উপমহাদেশের অনেকেই এই দিনটি ইবাদত ও দান-খয়রাতের মাধ্যমে উদযাপন করে থাকেন। কিছু মানুষের মতে, আখেরি চাহার সোম্বা উপলক্ষে যদি কেউ নফল নামাজ পড়েন বা আল্লাহর নামে গরিব-দুঃখীদের মাঝে দান করেন, তবে এতে ব্যক্তি ও সমাজের কল্যাণ সাধিত হয়। তাই এই দিনটি পালনে কোনো দোষ নেই, কারণ দানে ও ইবাদতে মানুষ পরিশুদ্ধ হয় এবং সম্পদ বৃদ্ধি পায়।